আলোচনা শুরুর আগে আসুন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নিই যা আমাদের এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর বুঝতে সহযোগিতা করবে।
আমরা সবাই চাঁদের সম্মন্ধে কিছুটা হলেও জানি। কারন মেঘলা দিন আর অমাবস্যা ছাড়া আমরা সবদিনই রাতের আকাশে চাঁদ দেখতে পাই। চাঁদ নিয়ে আমাদের অনেকের মধ্যেই কৌতূহল দেখা যায়।চাঁদ প্রায় প্রতি ৬২৬ ঘণ্টায় একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। পৃথিবীর হিসেবে সেটা ২৭.৩২ দিনের মত।
কক্ষপথের উপবৃত্তাকার আকৃতির কারণে এই ২৭ দিনের প্রতিদিন একই পরিমাণ কৌণিক দূরত্ব চাঁদ পাড়ি দেয় না। কেপলারের সূত্র অনুযায়ী কম-বেশি হয়। তারপরেও বলতে পারেন যে, প্রতি ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ১৩ ডিগ্রী পূর্ব দিকে সরে যায়।
সূর্যগ্রহণ |
এখন একমাস মানে যদি ৩০ দিন ধরেন, তাহলে এই সময়ে চাঁদ ৩৯৫ ডিগ্রী ঘোরে। মানে একটা পূর্ণ আবর্তন দিয়ে আরো ৩৫ ডিগ্রী বেশী চলে যায়।
আবার এই ২৭.৩২ দিনেই চাঁদ কিন্তু একবার বেশ খানিকটা উত্তর, তারপর আবার বেশ খানিকটা দক্ষিনেও ঘুরে আসে। কিন্তু সেটা বেশ জটিল বিষয়। ২৭.৩২ এর বিষয়টা আরেকবার দেখা যাক।
চাঁদ যে ২৭.৩২ দিনে ৩৬০ ডিগ্রী ঘুরে আসে, এর মধ্যে পৃথিবী নিজেও যেহেতু সূর্যের চারপাশে ঘুরছে, এই ২৭.৩২ দিনে সেও প্রায় ২৬ ডিগ্রীর মত সামনে এগিয়ে চলে যায়, সাথে নিজের অক্ষের উপরেও ২৬ ডিগ্রী বেশি ঘোরে, যাতে ২৪ ঘন্টা পরে আবার একই অঞ্চলে দুপুর হয়, যেখানে ২৪ ঘণ্টা আগে দুপুরই ছিল। ছবি এঁকে দেখলে বুঝতে পারবেন যে, ২৪ ঘণ্টায় পৃথিবীকে প্রায় ৩৬১ ডিগ্রী পাক খেতে হয়।
কোন এক রাতের পূর্ণিমার চাঁদ ২৭.৩২ দিনে ৩৬০ ডিগ্রী ঘুরে এসে দেখে সে তখন আর আগের একই দশায় পৌঁছতে পারছে না। তার জন্যে তার আরও ২৬ ডিগ্রী এগোতে হবে, মানে প্রায় ২ দিনের কাজ। মোট হলো ২৯.৩২ দিন। আবার এই দুই দিনও তো পৃথিবী থেমে থাকবে না, আরো প্রায় ২ ডিগ্রী এগিয়ে যাবে। এইটুকুও মিটিয়ে নিতে হবে।
সব মিলিয়ে আমাদের পৃথিবী থেকে আমরা চাঁদকে ২৯.৫৩ দিনে একবার ঘুরতে দেখি। সেটাও কিন্ত ঠিকঠিক ৩০ দিন (এক মাস) নয়।
আশা করি এই পর্যন্ত সবকিছুই খুব সহজে বুঝে গেছেন। এবার তবে "গ্রহণ" নিয়ে আলোচনা করা যায়। এই পর্যায়ে "গ্রহণ" কি এবং কিভাবে সংঘটিত হয় সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
একটি মহাকাশীয় বস্তু দেখার সময়, যদি অপর একটি মহাকাশীয় বস্তুর তা আড়ালে চলে যায়, তখন গ্রহণ সংঘটিত হয়। এরূপ ঘটনা ঘটার সময়, একটি মহাকাশীয় বস্তুর সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে আড়ালে চলে যেতে পারে। যখন একটি মহাকাশীয় বস্তু সম্পূর্ণভাবে, অপর মহাকাশীয় বস্তুর আড়ালে চলে যায়, এবং তখন তৃতীয় মহাকাশীয় বস্তু থেকে তাকে পূর্ণগ্রাস বলা হয়। একইভাবে যদি মহাকাশীয় বস্তুটি যদি আংশিকভাবে আড়ালে চলে যায়, তখন তাকে আংশিক গ্রাস বা খণ্ডগ্রাস বলা হয়।
গ্রহণের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হয় তৃতীয় একটি মহাকাশীয় বস্তু থেকে। যেমন সূর্য, পৃথিবী এবং চন্দ্র নিয়ে যে গ্রহণ সংঘটিত হয়, তা পর্যবেক্ষণ করা হয় পৃথিবী থেকে। চন্দ্র, সূর্য, ও পৃথিবী নিয়েই শুধু গ্রহণের বিষয়টি ঘটে না। এর বেশির ভাগই সাধারণ মানুষের কাছে অজ্ঞাত থেকে যায়। পৃথিবীর সাধারণ মানুষের কাছে সবচেয়ে পরিচিত দুটি গ্রহণ হলো― সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ।
সৌরজগতে সূর্যকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে পৃথিবী, আবার পৃথিবীকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে চন্দ্র। এই বিচিত্র আবর্তন চলার সময় কখনো কখনো সূর্য, পৃথিবী এবং চন্দ্র একই সরল রেখাতে অবস্থান নেয়। আর তখনই চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণের সৃষ্টি হয়। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চন্দ্রগ্রহণের চেয়ে সূর্যগ্রহণ বেশিবার হয়। প্রতি সাতটি গ্রহণের মধ্যে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের অনুপাত ৫:২ বা ৪:৩।
তাহলে "সূর্যগ্রহণ" কি?
আবর্তনের সূত্রে, যখন সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে চন্দ্র অবস্থান নেয়, তখন পৃথিবীপৃষ্ঠের পর্যবেক্ষকের দর্শন-সাপেক্ষে সূর্য চন্দ্র-এর পেছনে আড়ালে চলে যায় এবং তখন সূর্য গ্রহণ ঘটে। এই সময় সূর্যের আলো চাঁদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে চাঁদের ছায়া পৃথিবীর উপর পড়ে। সূর্যের আকার অনেক বড় বলে সূর্যগ্রহণের সময় চাঁদ পুরোপুরি ঢাকতে পারে না। বিশেষ করে চাঁদের চার পাশ দিয়ে সূর্যের ছটামণ্ডল ও বর্ণমণ্ডল উজ্জ্বলভাবে দেখা যায়। এই অবস্থায় একে বলয়গ্রাস বলা হয়।
ব্যাবিলনীয় সভ্যতা থেকে সূর্যগ্রহণের পর্যায়কাল মাপার চেষ্টা শুরু করছিল। ১০০০ খ্রিষ্ট- পূর্বাব্দের দিকে গ্রহণের পূর্বাভাস মানুষ দিতে সক্ষম হয়। ঐ সময় জ্যোতিষীরা লক্ষ্য করেন যে, প্রতি ১৮ বছর ১০ দিন পরপর গ্রহণ পুনরাবর্তিত হয়। এই থেকে সারোস চক্র (পুনরাবৃত্তি চক্র) দিয়ে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণগুলি চিহ্নিত করার প্রথা চালু হয়। ইংরেজীতে একে Solar eclipse বলে।
এবার তবে "চন্দ্রগ্রহণ" কি সে সম্পর্কে জানে নেই।
আবার পৃথিবী যখন চন্দ্র ও সূর্য-এর মধ্যে চলে আসে, তখন পৃথিবীর আড়ালে চাঁদ ঢাকা পড়ে এবং চন্দ্রগ্রহণ হয়। সূর্য একটি তারা বলে তার আলো পৃথিবীতে বাধা পায় এবং চাঁদ পৃথিবীর ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায়। পৃথিবী চাঁদের চেয়ে বড় হওয়ায়, পৃথিবীর ছায়া চন্দ্রপৃষ্ঠকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলে। এই কারণে চন্দ্রগ্রহণ পৃথিবীর কোনো কোনো অংশে পূর্ণগ্রাস হিসাবে দেখা যায়।
এই পূর্ণগ্রাস বা আংশিকগ্রাস পৃথিবীর সকল স্থান থেকে একই রকম দেখা যায়। কিন্তু পৃথিবীর সকল স্থানে কোনো না কোনো সময় পূর্ণ বা আংশিক গ্রহণ দেখা যায়। ইংরেজীতে Lunar eclipse বলে।
বেশ! আমরা এরমধ্যে সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে গেছি। এবার তবে আসল আলোচনায় আসি। প্রতিমাসে চাঁদ যদি পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণই করে, তাহলে প্রতি মাসে চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ হয় না কেন? খুব মনোযোগ দিয়ে বাকি লেখাটুকু পড়ে ফেলি।
চাঁদ পৃথিবীর বিষুবরেখা বরাবর না ঘুরে, বিষুবরেখার সাথে ৫° কোণ করে ঘোরে। ফলে প্রায়-ই পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপরে পরে না। যখন চাঁদ ঠিক পৃথিবীর ছায়া বরাবর থাকে, তখনই চন্দ্রগ্রহণ হয়। অর্থাৎ আমরা বলতে পারি যে পৃথিবী যখন চাঁদ আর সূর্যের ঠিক মাঝ বরাবর আসে তখনই কেবল আমরা পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পতিত হতে দেখি যা চন্দ্রগ্রহণ। এখন যেহেতু চাঁদ ৫° কোণ বরাবর ঘুরতে থাকে তাই প্রত্যেক মাসে পৃথিবী, চাঁদ এবং সূর্যের মাঝ বরাবর থাকতে পারে না। আর ঠিক এই কারনেই আমরা প্রতিমাসে চন্দ্রগ্রহণ দেখতে পাই না।
পাঠক, আপনার কাছে এখন প্রশ্ন আমরা প্রতিমাসে কেন সূর্যগ্রহন দেখতে পাই না? কমেন্ট করে জানাবেন সবাই আশা করি।
ধন্যবাদ। প্রবন্ধটি পছন্দ হলে ব্লগের অন্য লেখাগুলো পড়বেন।
No comments:
Post a Comment