মানুষ হিসেবে আমাদের স্বভাবসুলভ কিছু কথা আমরা প্রায়ই বলে থাকি কিংবা বলে থাকি যে এই ঘটনা ঘটার কারনে এই খারাপ হয়েছে। একটা উদাহরণ দেই। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলোতে ভালো কিংবা খারাপ ফলাফলের উপরে নির্ভর করে আমরা দুই রকমের প্রতিক্রিয়া দেখাই। ফলাফল আশানুরূপ হলে তার কৃতিত্ব নিজেদেরকে দিয়ে থাকি। আর ফলাফল যখন আমাদের পছন্দমতো হয় না, আমরা তখন বাইরের বিভিন্ন নিয়ামকের উপরে দোষ দেওয়ার চেষ্টা করি। যেমন: ক্লাসে শিক্ষক ভালো পড়ায়নি, প্রশ্ন কঠিন এসেছিল কিংবা পরীক্ষার বিষয়টিই অনেক কঠিন ছিল ইত্যাদি।
স্পষ্টত আমরা নিজেদের আশানুরূপ কিছু দেখতে না পেলেই বিভিন্ন কারণ দর্শাই বা অন্য কারও উপর এই দায়ভার ঝেড়ে দেই। আমরা অনেকেই প্রায়শ একটা কথা বলি,
"বাঙালির তিন হাত-ডান হাত, বাম হাত আর অজুহাত"
সাফল্যের সকল কৃতিত্ব নিজের আর ব্যর্থ হলে তার দায় যেসব ঘটনা আমাদের পক্ষে কাজ করেনি সেগুলোর উপর দেয়া আসলে খুবই ক্ষতিকর। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে সেলফ সারভিং বায়াস।
সেলফ সারভিং বায়াস দেশ বা রাষ্ট্রের বড় বড় ঘটনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত একটি গবেষণায়, জলবায়ু পরিবর্তন নীতিমালাগুলোর ব্যাপারে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, সে ব্যাপারে জরিপ চালানো হয়েছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে এই জরিপ চালিয়ে গবেষকরা দেখতে পেলেন, বেশিরভাগ ছাত্রই জাতীয়তাবাদ সেলফ সারভিং বায়াস ধারণ করে। গ্রিন হাউজ গ্যাস অপসারণে ব্যর্থতার জন্যে তারা অন্য দেশগুলোকে বেশি দায়ী করে।
১৯৮৭ সালের একটি গবেষণায়, ব্যক্তিগত ও দলীয় খেলার খেলোয়াড়দের মধ্যে সেলফ সারভিং বায়াস তুলনা করে দেখা হয়েছে। এই গবেষণায় টেনিস, গল্ফ, বেজবল, ফুটবল এবং বাস্কেটবল খেলোয়াড়দের থেকে ৫৪৯টি বিবৃতি জড়ো করা হয়েছিল। দেখা গেল, ব্যক্তিগত খেলোয়াড়েরা সেলফ সারভিং বায়াস বেশি প্রদর্শন করছে। গবেষণাটি উপসংহার টানে, ব্যক্তিগত স্পোর্টসে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স তাদের আত্মমর্যাদার উপরে অনেক বেশি অর্থপূর্ণ প্রভাব ফেলে। তাই, সেলফ সারভিং বায়াস তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে। অবচেতনভাবেই তারা তখন এর আশ্রয় নেয়।
সেলফ সারভিং বায়াসের কারণ অনুসন্ধানে প্রথমেই আসে আত্মমর্যাদাবোধের কথা। ব্যর্থতার দায় অন্য অনুষঙ্গকে দিলে মানুষের আর সমালোচনার কোনো ভয় থাকেনা। সেলফ সারভিং বায়াস আমাদের সত্যিকারের ব্যক্তিত্ব এবং বাস্তবতাকে একটি তির্যক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে বাধ্য করে। এভাবে আমরা নিজেদের আত্মমর্যাদাবোধ নিরাপদ রাখার চেষ্টা করে। ১৯৮৭ সালে দলীয় ও ব্যক্তিগত খেলোয়াড়দের নিয়ে একটি গবেষণায় দেখা যায় ব্যক্তিগত খেলোয়াড়েরা সেলফ সারভিং বায়াস বেশি প্রদর্শন করছে। এর কারণ চিহ্নিত করা হয় স্পোর্টসে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স তাদের আত্মমর্যাদার উপরে অনেক বেশি অর্থপূর্ণ প্রভাব ফেলে। তাই, সেলফ সারভিং বায়াস তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করে। অবচেতনভাবেই তারা তখন এর আশ্রয় নেয়।
এছাড়া আর একটি উল্লখযোগ্য কারণ হচ্ছে মানুষ সবসময় আশাবাদী। আমরা যখন অপ্রত্যাশিত ফলাফল পায় তখন তা সহ্য করতে পারিনা। তাই নেতিবাচক ঘটনাগুলোর দায় বাইরের ফ্যাক্টরগুলোর উপর দিয়ে আঘাত থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে চাই। আশাবাদী মনোভাবের পাশাপাশি আমরা আরেকরকম ভুলের শিকার হই।মনোবিজ্ঞানীরা এটার নাম দিয়েছেন 'এট্রিবিউশন ইফেক্ট'। এর ফলে দেখা যায় আশেপাশের কেউ ভুল করলে আমরা তাকেই ব্যক্তিগতভাবে দোষারোপ করি কিন্তু সেই একই ভুল নিজেরা করলে পরিস্থিতিকে দোষ দেয়।
ডিপ্রেশনের সাথে সেলফ সারভিং বায়াসের সম্পর্ক নিয়েও আজকাল গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হচ্ছে। ক্লিনিক্যালি ডিপ্রেসড মানুষেরা সাধারণ মানুষের তুলনায় এই বায়াসটি কম প্রদর্শন করে। তারা অপ্রত্যাশিত ফলাফলগুলোকে নিজেদের দোষ এবং চরিত্রের উপরে দিয়ে থাকে। অন্যদিকে, সাফল্য পেলে তার অবদান বাইরের নিয়ামকগুলো এবং ভাগ্যকে দিয়ে থাকে। সেলফ সারভিং বায়াস এড়ানোর পেছনে এ ধরনের মানুষের প্রধান ভূমিকা হচ্ছে, নিজেদের নেতিবাচক আবেগ চিহ্নিত করা ও নিজের কার্যক্রম ও অবদানের প্রতি লক্ষ রাখা।
সেলফ সারভিং বায়াস বিভিন্ন বয়স ও সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে বিভিন্নভাবে দেখা যায়। গবেষকরা জানিয়েছেন, কম বয়সী এবং বৃদ্ধদের মধ্যে এই বায়াসটির ব্যাপকতা বেশি দেখা যায়। সংস্কৃতিগত দৃষ্টিকোণ থেকে, এই বায়াসে মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাবের ব্যাপারে গবেষকরা এখনো একমত হতে পারেননি। তারা বিশেষভাবে পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্যের সংস্কৃতির সাথে সেলফ সারভিং বায়াসের ভিন্নতা কীভাবে জড়িত, সে ব্যাপারে কাজ করছেন। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মতো ব্যক্তিবাদী সংস্কৃতি অনুশীলন করা হয়, সাফল্য ও আত্মমর্যাদার উপরে সেখানে প্রচণ্ড গুরুত্বারোপ করা হয়। তাই নিজেকে ব্যর্থতার দায় থেকে মুক্ত করার জন্যে বায়াসের প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
পাঠক, আজকের ব্লগটি কেমন লেগেছে জানাতে ভুলবেন না। এছাড়াও অন্য ব্লগগুলোও পড়বেন আশা করি। আজকের ব্লগ তবে এপর্যন্তই। ধন্যবাদ।
No comments:
Post a Comment